কলকাতার নিজস্ব সুপারম্যান Uber ড্রাইভার বিনোদ
কলকাতার ঐতিহ্য হল কলকাতা একটি মানবিক শহর। ব্যস্ততার ফাঁকেও এই শহরের মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান। কাজের থেকেও মানুষ মানুষের মূল্য বেশি দেন। এটাই চলে আসছে আবহমান কাল ধরে। তা বলে কি হিংসা হানাহানি নেই! তা নয়। কিন্তু রাস্তায় একজন অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে কিংবা কোনও মানুষ রাস্তায় বিপদে পড়লে কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেনই। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেনই। এটাই কলকাতার দস্তুর।
দিল্লি, মুম্বাই কিংবা বেঙ্গালুরুতে এমন হয় না। কেউ আগবাড়িয়ে কাউকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন না। পরিচিত অপরিচিত কারও রক্তের প্রয়োজন হলে এই কলকাতা রাত জাগে। পাশের বাড়ির মাসিমার খুড়তুতো দাদার মেয়ের ভাসুরের জন্যে এ ব্লাডব্যাঙ্ক থেকে ও ব্লাডব্যাঙ্ক ছুটোছুটি করে রক্ত জোগাড় করে। এমনটাই কলকাতা। কাজ নেই। পকেটে অনেক টাকা নেই। ফেরারি, লোম্বার্গিনি হাঁকানোর ইচ্ছেও নেই। অথচ মনের দিক থেকে অনেকের থেকে অনেক বড়লোকদের এই শহর। যে দিকে তাকাবেন পেয়ে যাবেন এক একজন সুপার ম্যানকে। যাদের পকেটে কত টাকা আছে তার বালাই নেই, কিন্তু মন দরাজ। পাড়ায় পাড়ায় অজ্ঞাত পরিচয় এই সব সুপারম্যানেদের ভিড় ঠেলে একজন উঁকি দিলেন। নাম বিনোদ নায়েক। পরোপকারী বিনোদ এই নামেই তার রাজ্য জোড়া খ্যাতি। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুরস্কৃত করেছেন এই সহৃদয় মানুষটিকে। পুলিশ মহলে অনেকেই ভদ্রলোককে চেনেন। শুনুন বিনোদের কাহিনি।
বিনোদ নায়েক। পার্কসার্কাসের বাসিন্দা। বছর দুয়েক হল উবেরে গাড়ি চালাচ্ছেন। বাপ দাদার বাড়ি ছিল ওড়িশায়। কাজের সন্ধানে, পেটের তাগিদে এক প্রজন্ম আগে ওরা কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতার মত ব্যস্ত একটি শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছিলেন পার্ক সার্কাস এলাকায়। কলকাতায় তখন কাজের স্রোত ছিল। রাজনীতির ময়দান তুমুল ছিল। কিন্তু তবু দিন আনি দিন খাই পরিবারগুলির গুজরান হয়েই যেত। সে সময় চটকল চলত। ভোঁ সাইরেন বাজলেই শ্রমিকেরা সার বেঁধে ঢুকতেন কারখানায়। লোহা লক্কড়ের কারখানা। ময়দা তৈরির কারখানা। চট তৈরি, তুলো থেকে সুতো তৈরি। সুতো থেকে কাপড় তৈরির সে এক ধূম লেগে যেত রোজ। সেই সাইরেন শুনে গ্রাম গঞ্জ থেকে রোজই লোক আসত এই কল্লোলিনী শহরে। ভোর হতে না হতেই উনুনের ধুয়োয় আকাশ অন্ধকার করে আসত। সেই ধুয়োয় রেখা এঁকে এঁকে হাসিখুশি সূর্যের সহজ আলো ঢুকত বস্তির টালির চাল ভেদ করে। বেড়ার ফোকর গলে। পার্ক সার্কাসের পচা চামড়ার গন্ধ সেদিনও ছিল। সেই সব ধুয়ো আর চামড়ার গন্ধ মেখে বড় হয়েছেন এই সুপার ম্যান। বিনোদের বাবা বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছেন। দুবেলা দুমুঠোর সন্ধান করেছেন। ইউকো ব্যাঙ্কে ঠিকে পিওনের কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। নুন আনতে পান্তা ফুরায় পরিস্থিতিতে বিনোদের মা লোকের বাড়ি বাসন মেজেছেন। ঠিকে ঝির কাজ করেছেন। বিনোদও ছোটবেলা থেকেই লেগে পড়েছিলেন টাকার জোগাড় করতে। সংসারের হাল ধরতে। স্কুলে পড়তে পড়তেই কাজ করতেন বিনোদ। টায়ারের ব্যাগ তৈরির কাজ। স্কুল থেকে ফিরেই শুরু করে দিতেন সেই কাজ। দুটাকা রোজগার করতেও কাল ঘাম বেরিয়ে যেত ছোট্ট ছেলেটার। ও তখন ক্লাস সিক্সে, লেখাপড়ায় ইতি টেনে ঢুকতে হল বেসরকারি সংস্থায় পিওনের কাজে। ১৯৮৫ সালের কথা। সেই সময় টাকার মূল্য ছিল। কিন্তু তবু সারা মাস হাড় ভাঙা খাটুনির পর ওই সারে তিনশ টাকার অঙ্কটা বড্ড ছোট ছিল। কেউ একজন যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। চাকরিটা পাওয়ায় তার প্রতি কৃতজ্ঞতা এখনও আছে বিনোদের। সেই কাজ করতে গিয়ে অনেক কিছুই শিখে ফেলেছেন বিনোদ। ইংরেজিতে কথা বলতে ইচ্ছে করত। তাই যেই সংস্থায় পিওনের কাজ করতেন তার মালিক ওকে অফিস ছুটির একটু আগেই ছুটি দিয়ে দিতেন। আর অফিসের দিদিমণিরা ওকে নিয়ে বসতেন ইংরেজি শেখাতে। কাজের থেকে ফিরে এক ট্যাক্সিচালক বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়তেন কলকাতার রাস্তায় হেল্পর হিসেবে। হেল্পারি করতে করতেই একটু একটু করে শিখে ফেলেন গাড়ি চালানোর খুঁটিনাটি। রাত বাড়লে রাস্তা একটু ফাঁকা হলে শুরু হত ওই ট্যাক্সিতে ট্রায়াল দেওয়ার কাজ। এভাবেই হাত পাকিয়েছেন। শিখেছেন ড্রাইভারি করতে।
সমাজের কাছ থেকে যা পেয়েছেন তাই দিয়েই তৈরি হয়েছে বিনোদের মূল্যবোধ। তাই দিয়েই সামাজিক দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যেতে পারেন না এই সুপারম্যান। কেউ সমস্যায় পড়েছে জানতে পারলে সবার আগে তিনিই ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করেন। পকেটে টাকা নেই তু কুচ পরোয়া নেই। গায়ে খেটেই সমস্যার সমাধান করতে এক পায়ে খাড়া। পথে ঘাটে পাড়ায় এলাকায় বেপাড়ায় কেউ কোথাও অন্যায়ের শিকার হচ্ছেন জানতে পারলে তিনিই সবার আগে এগিয়ে যান প্রতিবাদ করতে। আর এই জন্যে সমস্যাতেও পড়তে হয় কখনও কখনও। কিন্তু প্রখর বুদ্ধির জোরে সব বাধা টপকে যান এই সুপারম্যান বিনোদ। বলছিলেন, সমাজকে ফিরিয়ে দেওয়ার দায় ওকে আরও ভালোমানুষ হতে শিখিয়েছে। কথায় বলে ভালো কাজে পুরস্কার আর মন্দ কাজে তিরস্কার। ফলে ওর ভাগ্যে পুরস্কারই বাঁধা। মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে পাওয়া অভিনন্দন পত্র আগলে রেখেছেন।
বলছিলেন সেবা করার সুযোগ পেলে ওর নাকি খুব ভালো লাগে। বছর কুড়ি বয়স হবে। তখন একবার এক ভদ্রলোককে বালিগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন ধরতে গিয়ে পড়ে যেতে দেখেন। তার পর তাঁকে বাঁচানোর লড়াই শুরু করে দেন বিনোদ নায়েক। রক্তাক্ত ভদ্রলোককে বুদ্ধি করে সামনের হাসপাতালে নিয়ে যান। রক্তের প্রয়োজন বুঝে রক্ত জোগাড় করে দেন। বাড়িতে খবর দেন। গভীর রাত পর্যন্ত ছুটোছুটি করে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর মুখ থেকে ওই অপরিচিত ভদ্রলোককে ফিরিয়ে আনেন। সেই আনন্দই ওকে আরও আনন্দ পাওয়ার লোভ দেখায়। অসহায় মানুষের পাশে থাকার অনাবিল আনন্দের লোভ সামলাতে পারেন না এই সুপারম্যান। রাস্তায় কাউকে পড়ে থাকতে দেখলে তাকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত শান্তি পান না। সবাই যখন আহত আক্রান্ত দুর্ঘটনা-গ্রস্তকে লুঠ করতে ছোটে তখন চোখ ফেটে কান্না আসে বিনোদের। পুলিশের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে বহু উদ্ধারে কাজ করেছেন এই ভদ্রলোক। ঘটনাচক্রে ড্রাইভারি জীবনের অধিকাংশ সময়টাই গিয়েছে পুলিশ, আই পি এস অফিসার, আই এস অফিসারদের গাড়ি চালিয়ে। তাই পুলিশ প্রশাসনকে যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই সে কথা শিখে ফেলেছেন বিনোদ। শুধু তাই নয়, পুলিশের বড় কর্তাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে অনেক জটিল সমস্যা সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল হয়েছেন। শিখেছেন সামাজিক দায়িত্ব পালন করার সত্যিকারের অর্থটা ঠিক কী। সাম্প্রতিক বেশ কিছু জটিল কেসের তদন্ত হতে, এবং কিনারা হতেও দেখেছেন। ফলে পুলিশের সাফল্য দেখে গর্বিতও হয়েছেন বিনোদ। আর এই সব কিছুই ওকে তৈরি করেছে। শুধু যে সমাজের ভালো ভালো দিকগুলো ওকে ভালো করেছে তাই নয়। ওর দেখা আছে মুদ্রার অপর পিঠটাও। ফলে সেখান থেকে শিখেছেন কী বর্জন করতে হবে। মার্জনা করতেও শিখেছেন নিজের জীবন দিয়ে। বলছিলেন, ওর একটা ছোট্ট ব্যবসাও ছিল। খাবার দোকানের একটা ছোট্ট স্টল। নেতাজি ভবনের উল্টো দিকে। অস্থায়ী একটা ছোট্ট দোকান। বাড়ি থেকে খাবার বানিয়ে নিয়ে যেতেন সাইকেলে করে। ওখান থেকে বিক্রি হত। সঙ্গীও ছিল একজন। কিন্তু সময়ের ফেরে ওই সঙ্গী বিনোদের ব্যবসা কেড়ে নেয়। এরকম ঘটনায় আর পাঁচটা মানুষ সংঘর্ষে যাওয়াটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করতে পারে কিন্তু বিনোদ নিজেকে গুটিয়ে নেন। এই ভেবে, গরিব ঘরের ছেলে করে খাবে তো খাক। এ হেন নির্বিবাদী উবের ড্রাইভার, সমাজসেবী উদ্যোগপতি বিনোদ এলাকার দুঃস্থ শিশুদের জন্যে একটি সংগঠন তৈরি করেছেন। নাম দিয়েছেন চিলড্রেন ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। ফি বছর দরিদ্র ঘরের একশটি শিশুকে খাতা বই দেওয়ার কর্মসূচি পালন করেন। পাড়ায় পাড়ায় গাছ বিলি করে বেড়ান। স্ত্রী নিশা আর বছর তেরর ফুটফুটে ছেলে আর্য গরিব বাবার আকাশ সমান মনের গর্বে আহ্লাদে আটখানা। নিজের উদারতাকে সানন্দে উদযাপন করেন এই সমাজসেবী উবের ড্রাইভার। উবেরও খুশি। তাই তাকে সম্বর্ধনা দিয়েছে উবেরও।