বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের জীবনের নানা মোড়
হতে পারে কাকতালীয় ঘটনা। কিন্তু ১৫ অগাস্ট শ্রী অরবিন্দের আবির্ভাব দিবসও বটে। শ্রী অরবিন্দের ভক্তরা এর পিছনে দৈব ইশারা খুঁজে পান। বিপ্লবী নিজেও মনে করতেন এই দিনের তাৎপর্য আছে।
শ্রী অরবিন্দ বড় হয়েছেন একটি নির্দিষ্ট জীবন দর্শন নিয়ে। ভারত থেকে দূরে। ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। বাবা কৃষ্ণধন চেয়েছিলেন আদ্যপান্ত সাহেব হয়ে উঠুক ছেলে। সাধারণ ভারতীয়ের মত হতভাগ্যের শিকার যাতে না হয় তাঁর সন্তান তাই শিশুকাল থেকেই শ্রী অরবিন্দকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এমন পরিবেশে যাতে ভারতীয়ত্বের ছোঁয়াচ না লাগে। বিশ্বাস করতেন "জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক সাহেবি।" বাবার এরকম ইচ্ছে এতটাই প্রবল ছিল যে শ্রী অরবিন্দের মিডল নেম রেখেছিলেন অ্যাক্রয়েড। ছোটবেলায় তাঁকে দার্জিলিংয়ের লোরেটো হাউস নামে একটি আইরিশ স্কুলে পড়তে পাঠিয়ে দেন। যাতে বিদেশি প্রভুদের সঙ্গে মিলেমিশে যেতে পারেন অরবিন্দ। পরে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। সেখানেই পড়াশুনো করেন। ম্যানচেস্টারে রেভারেন্ড ডব্লিউ এইচ ড্রেওয়েটের তত্ত্বাবধানে ল্যাটিন, গ্রিক, জার্মান, ইটালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, অঙ্ক এবং ভূগোল শিখেছিলেন। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রাইপস পাস করেন। আই সি এস পরীক্ষার জন্যে ক্যামব্রিজের কিংস কলেজেও পড়াশুনো করেন। ১৮৯৩ সালে স্টেট সার্ভিস অফিসার নিযুক্ত হন। দেশে ফিরে আসেন।
বরোদা কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। ফরাসি ভাষার শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। পরে এই কলেজেই ভাইস প্রিন্সিপাল হন। এখানেই বাংলা এবং সংস্কৃত শিখেছেন। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রেমে পড়েছেন এই বরোদাতেই। এবং এরপর ধীরে ধীরে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বাংলা এবং মধ্যপ্রদেশের বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন।১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গ ঘোষিত হওয়ার পর বাংলায় মনোনিবেশ করেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সামিল হন। (১৯০৫-১৯১১) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯০৬ এ কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হন। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি গোপন বিপ্লবী দলও গঠন করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে যাতায়াত করতে থাকেন। ব্রিটিশ বিরোধী প্রচার চালাতে থাকেন পুরোদমে। ১৯০৮ এ আলিপুর বোমা মামলায় গ্রেফতার হন অরবিন্দ ঘোষ। অন্য স্বাধীনতা সংগ্রামীর সঙ্গে বছর খানেক চলে সেই মামলার শুনানি। চিত্তরঞ্জন দাস অরবিন্দ ঘোষের আইনজীবী হিসেবে মমলা লড়েন। জেলখানার অন্ধকারে চিত্তরঞ্জন দাসকে দেখে শ্রীকৃষ্ণের দর্শন হয় শ্রী অরবিন্দের। আধ্যাত্মিক বিকাশ পূর্ণতার দিকে এগোতে থাকে।
জেল থেকে বেরিয়ে কর্মযোগ এবং ধর্ম নামে বাংলা ভাষায় দুটি পত্রিকা চালু করেন। উত্তরপাড়া অভিভাষণে তিনি দেশবাসীর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। যেখানে একজন বিপ্লবী থেকে একজন আধ্যাত্মিক মানুষে রূপান্তরিত হওয়ার প্রথম বার্তা দেন।এরপরের ইতিহাস পন্ডিচেরিতে... এক এক করে তৈরি হয় আশ্রম। দেখা হয় শ্রীমার সঙ্গে। প্রকাশিত হতে থাকে আর্য পত্রিকা। তাঁর দার্শনিক রচনার সম্ভার বাড়তে থাকে। ১৯২৬ এ প্রতিষ্ঠিত হয় আশ্রম।
পন্ডিচেরির দিনগুলিতে কেবল আধাত্মিক বিকাশের দলিল রয়েছে। কিন্তু শ্রী অরবিন্দের ছোট ভাই বারীন্দ্র ঘোষের আপ্ত সহায়ক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এমন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে আলাপ চারিতায় উঠে এল আরও নানান তথ্য। তিনি মন্ত্রগুপ্তির মত লুকিয়ে রেখেছিলেন এই গোপন হদিস। ৯৬ বছরের এই স্বাধীনতা যোদ্ধা জানালেন ব্রিটিশের নাগালের বাইরে যাওয়ার তাগিদ ছিল। শ্রী অরবিন্দকে সেই মত বলা হয়েছিল চন্দননগরে যেতে। কিন্তু ফরাসি ঘাঁটি হিসেবে পন্ডিচেরিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। কারণ পণ্ডিচেরি এমন একটি জায়গা যেখানে বাঙালি বিপ্লবীরা প্রকাশ্যে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলে স্থানীয় সাধারণ মানুষ তা সহজেই বুঝতে পারবে না। ফরাসি সরকারি সহযোগিতাও পাওয়া যাবে। শুধু তাই নয় বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড রীতিমত চলত পণ্ডিচেরি থেকেই। বলছেন শ্রীঅরবিন্দের স্নেহ ধন্য বিপ্লবী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য। বললেন, গোপন ভাষায় চিঠি আদান প্রদান যে হত পন্ডিচেরির আশ্রম থেকে তারও অনেক নিদর্শন ইতিহাস আছে। ফলে আশ্রমকে কেন্দ্র করে আশ্রয় স্থলও তৈরি হয়েছিল পন্ডিচেরিতে। ফলে আধাত্মিকতার পাশাপাশি গোপন রাজনৈতিক মাপঝোঁকের ইঙ্গিতও দিয়েছেন এই বর্ষীয়ান স্বাধীনতা সংগ্রামী। পন্ডিচেরিতে থাকা কালীনই আরও একটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন শ্রী অরবিন্দ এবং শ্রী মা। তা শুধু বৃহত্তর ভারতের স্বপ্ন নয়, সংঘবদ্ধ পৃথিবীর স্বপ্ন। এই প্রকল্পের নাম দিয়েছিলেন World Union আজও সেই স্বপ্নের ধূনি জ্বালিয়ে রেখেছেন শ্রী অরবিন্দ অনুগামীরা।