ফিউশন ফুডে কলকাতায় সেরা জয়মাল্যর বোহেমিয়াঁ
মাছ মাংস দিয়ে যে পিঠে হয়! হতে পারে! তা দেখিয়ে দিয়েছেন কলকাতার পিঠে-বিলাসীর নবনীতা। সেই ফিউশনের কাহিনি আপনারা ইওরস্টোরি বাংলার পাতায় পড়েছেন ইতিমধ্যেই। আজ আলাপ করাবো এক বোহেমিয়ান শেফের সঙ্গে। কলকাতায় ফিউশন ফুডের অন্যতম সফল রেস্তোরাঁ। ক্লাব দে বোহেমিয়াঁর কর্ণধার জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃজনশীল ফিউশনই ওর রেস্তরাঁর ইউএসপি।
যেমন ধরুন নলেন গুড়ের মশলাদার জল দিয়ে জিভে জল আনা ফুচকা। আলু মাখা পুরের বদলে কাঁকড়ার ঝোল আর লোভনীয় চিংড়ি। টক জলের লেগাসিকে জলে ফেলে এভাবেও যে ফুচকা হয় শেখালেন জয়মাল্য।
‘ক্লাব দে বোহেমিয়াঁ’ এ ঢুঁমারলেই পাবেন হরেক কিসিমের ফিউশনের ফান্ডা। এক্সপেরিমেন্টই ওর প্যাশন। তাই বোহেমিয়াঁ শুধু রেস্তোরাঁ নয় যেন আস্ত একটি গবেষণাগার।
ওহ! ক্যালকাটা, সিক্স বালিগঞ্জ প্লেস, ভজহরি মান্নাদের রমরমার মাঝখানেও জয়মাল্যর রেস্তরাঁ তাই অনন্য। কাহিনিটা এরকম। ওহ! ক্যালকাটার উঁচু পদ চাকরি করতেন জয়মাল্য। নিজে কিছু করার ইচ্ছেই ওকে রেস্তোরাঁ খোলার সাহস দিয়েছে। চাকরি ছেড়ে নেমে পড়েছেন নিজের ব্র্যান্ড তৈরির লক্ষ্যে। মেনুতে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছেন। সচরাচর কোনও ডিশ যেভাবে সবাই খেতে অভ্যস্ত সেই অভ্যেসটাই ভাঙতে চেয়েছিলেন এই শেফ। ফুচকার সঙ্গে নলেন গুড়ের জল, কিংবা ধরুন বিরিয়ানি ককটেল কেউ কখনও ভাবতেই পারেননি। কিন্তু সেটাই ও করে দেখিয়েছেন। আর গ্রাহকরাও দারুণ খুশি। জোমাটোর রেটিং বলছে ও গ্রাহকদের প্রায় সেন্ট পার্সেন্ট তৃপ্তি দিতে পারেন। চমকে দিতে পারেন উদ্ভাবনী ফিউশন দিয়ে। কন্টিনেন্টাল ফিউশন শুধু নয়, পরিচিত অপরিচিত খাবারের স্বাদ নিয়ে পরীক্ষামূলক টস করতে জানেন জয়মাল্য। প্রথা ভাঙা মেনু চেখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই হাতের যাদুতে পুরনো পদের আধুনিক সংস্করণ কেমন সুস্বাদু হয়ে উঠতে পারে। বোহেমিয়াঁ’এর কর্ণধারের লক্ষ্য ছিল সেটাই। বললেন, বার লাইসেন্স পাওয়ার পরেই ওরা একটা স্ন্যাক-টাইম উইথ লিকারের কনসেপ্ট ভেবেছিলেন। যাঁরা কমবয়সী এবং যাঁরা ইয়ং অ্যাট হার্ট, তাঁদের কথাই মাথা ছিল মেনু তৈরির সময়। সেই মেনু যা আপনার পছন্দের ককটেলের সঙ্গে ভাল যায়।
বালিগঞ্জে জয়মাল্যর এই রেস্তোরাঁর ককটেল কম্বিনেশন খাদ্যারসিকের কৌতূহলের কেন্দ্র। ধরা যাক কলকাতা বিরিয়ানি ককটেল। ভদকার সঙ্গে ফলের রস, মশলা, আর কয়েক রকম ফ্লেভার মিশিয়ে ককটেল তৈরি হয়। পরিবেশিত হয় বিরিয়ানি আলুর সঙ্গে। গন্ধরাজ মারর্টিনির কথায় আসি। গন্ধরাজ, লেবুর খোল আর ভদকার ককটেল। মেড ইন হেভেন হল হুইস্কি, ডার্ক চকোলেট আর ভ্যানিলা দিয়ে তৈরি। দ্য বেঙ্গল ডাব স্যাংগ্রিয়ায় কী আছে? হোয়াইট ওয়াইন, মরশুমি ফল, নারকোলের পাতলা শাঁস আর তার রস। ককটেলে পাঁচফোড়ন! ভাবা যায়? ভাবিয়েছেন জয়মাল্য। নিউ মুন ওভার কলকাতা ককটেলে রয়েছে হোমমেড পাঁচফোড়ন লিকার, ডার্ক রাম আর মশলা। ককটেলের এই কম্বিনেশন পাবেন শুধুমাত্র বোহেমিয়াঁয়, বুক ঠুকে বলেন শেফ।
এতো গেল ককটেল। স্টারটার আর মেন কোর্সের মেনুও চমকে ভরা। স্মোকড ফিশ টোস্ট দিয়ে শুরু করি। মাছের টোস্ট একদম ইউনিক। দেখলেই পেটে ছুঁচো ডন দেবে। জিভে জল আসবে। ক্রিসপি ফ্রায়েড মাশরুম পাবেন তিন ধরনের। স্টিমড চিকেন এনভেলপ ঠিক কীরকম সেটা না কথায় প্রকাশ করা যাবে না। ও আপনাকে চেখে দেখতেই হবে। আসলে কলা পাতায় মোড়া মাংসের পাতুড়ি বললে আপনি একটা আইডিয়া পেতে পারেন। কটেজ চিজ অ্যান্ড বার্নন্ট টমেটো মুস অন পাপড়ি। নাম পড়ে হাঁপিয়ে যাবেন না। মশলাদার এই পদ ভেজ। কিন্তু যাদের নিরামিষ আহারে অরুচি তাদের জন্যে জয়মাল্যর এটা ইয়র্কর। পোটাটো মেডালিয়নস উইথ ট্যামারিন্ড চিকপিজ। টিক্কিটা আলু আর কাঁচা আমের। সঙ্গে তেঁতুলের আলতো ছোঁয়া আছে। টকমিষ্টি! কিংবা ভেটকি উইথ থ্রি ওয়েজ করিয়্যান্ডার, যেখানে ধনেপাতা, ধনেপাতার গুঁড়ো এবং করিয়্যান্ডার সিড ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়াও স্মোক্ড চিকেন অ্যান্ড ক্রিম্ড চিজ ব়্যাপস, নলেন গুড় গ্লেজ্ড পর্ক বেলি অন পাপড়ি, ককটেল প্রন কাটলেট, পিক্লড গার্লিক ক্র্যাব অন টোস্ট— সবই মজাদার আর উদ্ভ্রান্ত ফিউশনে ভরা। সবচেয়ে আজব এই ফুচকার কম্বো। আমিষ কম্বোয় থাকছে গার্লিক কিমা ফুচকা উইথ স্পাইসি হানি-লেমন ওয়াটার আর ক্র্যাব অ্যান্ড প্রন ফুচকা উইথ স্পাইসি নলেন গুড় ওয়াটার। নিরামিষে পাবেন ওয়াক্স গোর্ড ফুচকা উইথ স্পাইসি হানি-লেমন ওয়াটার আর স্মোক্ড এগপ্লান্ট ফুচকা উইথ স্পাইসি নলেন গুড় ওয়াটার। ফুচকায় যারা মিঠাপানি পছন্দ করেন না তাদেরও বলে রাখি জয়মাল্যর তৈরি এই ফুচকা না খেয়ে বোহেমিয়াঁ ছাড়ার কথা ভাববেনই না।
মেনুতে পদের রকমারিতে ইতিমধ্যেই বোহেমিয়াঁ খাদ্যরসিকদের মনে জায়গা করে নিয়েছে। পকেটের কথা ভেবে জয়মাল্যর চালু করেছেন ‘বোহো আওয়ারস’, বিকেল ৪টে থেকে সন্ধে ৭টা পর্যন্ত। ২৫ ধরনের পদ, ৪ রকম অ্যালকোহলিক আইসক্রিম, পাঁচ রকমের ডেজার্ট আর ককটেল রয়েছে বোহো আওয়ার্সের মেনুতে। বোহো আওয়ার্সের মূল আকর্ষণ হল কম দাম। সচরাচর দামের থেকে অনেকটাই কমে পাওয়া যাবে খাবার, ককটেল, জানান জয়মাল্য।
মাছের ঝোল আর ভাত, বাঙালির গতে বাঁধা আহারের নিয়ম ভেঙে দিয়েছেন তরুণ এই শেফ কাম উদ্যোগপতি। সেই পাঁচফোড়ন, সেই নলেন গুড়, সেই শর্ষে গুড়ো, গন্ধরাজ লেবু—সব আছে কিন্তু অন্যভাবে, কেউ যেভাবে ভাবতে পারেনি সেভাবেই বাঙালির জিভে তুমুল বিপ্লব ঘটিয়েছেন জয়।