স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বদল আনতে চান Medera-র সায়ন্তন
কথায় কথায় মুখে মুখে ফেরে এরাজ্যে নাকি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উদ্যোগ নিয়ে কারও কোনও মাথা ব্যথা নেই। আমরা যে পিছিয়ে আছি একথা বিশ্বাস করতে যত না খারাপ লাগে তার থেকে ঢের গুণ বেশি তৃপ্তি হয় দোষারোপ করতে। রাজ্যের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে। আত্ম-সমালোচনার মত করে নয়, বরং পাড়ার ঠেকে, ভিড় বাসে, ট্রেনে, চায়ের আড্ডা, তির্যক শ্লেষের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিষণ্ণতাকে মিলিয়ে যে তিক্ত মিশ্রণ তৈরি হতে পারে তাতেই বরং বেশি সুখ পান সিনিকাল বাঙালি। এদের মাঝখান থেকে একের পর এক সমাধান সূত্র হাতে নিয়ে উঠে আসছেন একের পর এক উজ্জ্বল তরুণ। সমাধানের সুলুক নিয়ে গজিয়ে উঠছে একের পর এক স্টার্টআপ। বেলঘরিয়া, নাগের বাজার, ডানকুনি, সল্টলেক, নিউটাউন, বালিগঞ্জ একটু একটু করে পাপড়ি মেলে ধরছে কলকাতার স্টার্টআপ সংস্থাগুলি। মেধায় ক্ষুরধার তরুণদল। আবেগে একশ শতাংশ সৎ আর প্রেমিক এই তরুণদলের হাত ধরেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে কলকাতা। কেউ দেখুক বা না দেখুক। কেউ কদর করুক আর নাই করুক কলকাতার সমস্যাগুলোর নিজস্ব সমাধান নিয়ে আসছে কলকাতারই তরুণ প্রজন্ম।
আজ এমনই একজন স্টার্টআপ উদ্যোগপতির কথা বলব আপনাদের। নাম সায়ন্তন সাহা। বালুরঘাটের ছেলে। কলকাতায় এসেছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে পড়াশুনো করতে। হাজার হাজার কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারদের তালিকায় আরও একটি সাধারণ নাম হিসেবে জুড়ে যাওয়ার জন্যে নয়। ছোটবেলা থেকেই উদ্যোগপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন সায়ন্তন। বাবা ব্যবসায়ী। তাই রক্তে উদ্যোগ ছিল। ব্যবসা করার প্রাথমিক শর্ত যে সাহস সেটাও ছিল ছেলেটার। পাশাপাশি কিছু বানাবার, নতুন কিছু তৈরি করার উৎসাহ ছিল। একটা সময় ছিল সায়ন্তন স্বপ্ন দেখতেন ইঞ্জিনিয়ার হবেন। ব্রিজ বানাবেন। বড় বড় কনস্ট্রাকশন করবেন। এবং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি তৈরি করবেন। কিন্তু পড়তে হয়েছে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে। কম্পিউটার সায়েন্স তার আগ্রহের তালিকায় ছিল না। কারণ নিজে কিছু করার কথা ভাবতেন সায়ন্তন। নির্মাণ করার কথা। যা চোখের সামনে দেখা যায়। পড়াশুনোয় ভালো। তাই কম্পিউটারের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়ে গেল দ্রুত। কোডিং ভালোবেসে ফেললেন। মোজিলা ফাউন্ডেশনের ওপেন সোর্স সোসাইটিতে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন। থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় মাথায় একের পর এক আইডিয়া কিলবিল করতে থাকে। বাবার সঙ্গেই ওর যত গল্প। ব্যবসার আইডিয়া নিয়ে আলাপচারিতা। প্রথম থেকে ওর বাবা পরেশকুমার সাহাই ওর মেন্টর, ইনভেস্টর, পার্টনার। পরেশবাবুর দীর্ঘ কুড়ি বছরের ব্যবসার অভিজ্ঞতা। আমদানি রফতানি ব্যবসার পাশাপাশি কনস্ট্রাকশন সংস্থাও আছে। ব্যবসার সূত্রে কলকাতা বালুরঘাট করছেন এই কুড়ি বছর। ছেলের সঙ্গে বন্ধুর মত মিশেছেন। হাতে ধরে শিখিয়েছে ব্যবসার মৌলিক শিক্ষাটা। ওর বাবা বলেন পড়ে তুমি যেতেই পারো কিন্তু ধুলো ঝেরে ওঠার নামই সাফল্য। সেই সাফল্যের পিছনেই ছুটছেন এই তরুণ উদ্যোগপতি।
ফাইনাল সেমিস্টারের সময় সবাই যখন ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ নিয়ে চুল ছিঁড়ছে তখন সায়ন্তন একেবারে বিন্দাস। ও ঝক্কিতে যানইনি। বরং বেছে নিয়েছেন উদ্যোগপতি হওয়ার এবড়ো খেবড়ো রাস্তা। নিজের স্বপ্ন সফল করার নিজস্ব রাজপথ।
বলছিলেন একটি প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়ে আইডিয়াটা মাথায় আসে। তৈরি করে ফেলেন তথ্য-স্রোত ঘেঁটে এমন একটি অ্যালগোরিদম, যা চিকিৎসা ব্যবস্থার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। বিভিন্ন হাসপাতালের কার্যপ্রণালীকে প্রভাবিত করতে পারার মতো একটি প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবস্থার আবিষ্কার করে ফেলেছেন সায়ন্তন। যা শুধু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আরও ভালো পরিচালন কাঠামোই দেবে না, বরং দেবে সুচিকিৎসার পরামর্শও।
সায়ন্তন বলছিলেন, ওর দাদু মারা গিয়েছিলেন ফুসফুসের ক্যান্সারে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলেছে। নামি দামী বিভিন্ন হাসপাতালে। তখন ওর বয়স কম। মাত্র অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। কিন্তু অনুসন্ধিৎসা প্রখর। সে সময় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন কোথায় কোথায় গলদ তৈরি হচ্ছে বড়দের আলোচনা থেকে টের পেয়েছেন কোথায় কোথায় হারতে হয়েছে ক্যান্সারের সঙ্গে সম্মুখ সমরে। রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা, ওষুধ নির্বাচন সব ক্ষেত্রেই একটু একটু ফাঁক ফোকর উঁকি দিয়েছে ওই ছোট্ট সায়ন্তনের চোখে। দাদুকে হারানোর যন্ত্রণা থেকেই জীবনের দিশা খুঁজে পেয়েছেন এই ছেলেটি। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার সময় ফুসফুসের ক্যানসারের ডেটা নিয়ে একটি প্রজেক্ট তৈরি করতে গিয়েই মগজের আইডিয়া বাল্ব জ্বলে ওঠে। তিল তিল করে তৈরি করে ফেলেন একটা অ্যালগোরিদম। ডেটা বা তথ্য নির্ভর এমন অ্যালগোরিদম যা প্রাপ্ত তথ্যের প্যাটার্ন দিয়েই বলে দিতে পারবে রোগের ধরণ। পরীক্ষা নিরীক্ষার আগেই রোগীর রোগ প্রায় নিখুঁত অনুমান করতে পারবে। যা চিকিৎসকদের উপকারে আসবে। তথ্যের যোগান নিখুঁত হলে উত্তরও নিখুঁত হবে বলে জানালেন সায়ন্তন। ফলে এই প্রযুক্তি নির্ভর যুক্তি-ক্রম বা অ্যালগোরিদম দিয়েই তার উদ্যোগের যাত্রা শুরু করেন। ২০১৬ সালে খুলে ফেলেন মেডেরা হেল্থকেয়ার নামে তাঁর কোম্পানি। সায়ন্তনের বক্তব্য তার অ্যালগোরিদম চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যয় অনেকটাই কমিয়ে দেবে। ফলে সাধারণ মানুষের নাগালে চলে আসবে এই প্রযুক্তি নির্ভর চিকিৎসা। পাশাপাশি, সায়ন্তনের সংস্থা চিকিৎসাক্ষেত্রের বিভিন্ন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে চিকিৎসার সরঞ্জাম তৈরি করে। পাশাপাশি ক্লিনিক চালানোর জন্যে বাণিজ্যিক সফ্টঅয়্যার তৈরি করে দেয়। যার মারফত অসুস্থ মানুষকে আরও ভালো পরিষেবা দিতে পারে ক্লিনিকগুলি। জিনোম, ডিএনএ, প্লাসেন্টা নিয়েও নানান গবেষণার সরঞ্জামও তৈরি করে এই সংস্থা।